অনিকেত মানে যার ঘরবাড়ি নেই। অনিকেত শামীম একজন কবি। একজন লিটল ম্যাগকর্মী। একজন স্বার্থবুদ্ধিহীন সাহিত্যপ্রেমী। সাহিত্য যাত্রার পথে দীর্ঘদিন ধরে শামীমের একক যাত্রা। শুধু নতুন সাহিত্য পথের নতুন চিন্তারই অভিসারী নন তিনিÑ তিনি কাজপাগল মানুষ। নতুন স্বপ্নের সারণি। ‘অনিকেত শামীমের কবিতা’ নামে তার সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ পড়ে মুগ্ধ হলাম। ভিন্ন সুরের কবিতা। কাব্য ভাষাভঙ্গি একেবারেই আলাদা। গদ্যছন্দে তার কবিতা বিমূর্তরূপ ধারণ করেছে। বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে তিনি কবিতা নির্মাণ করেন। বাংলা কবিতার যে গীতিময়তা সচেতনভাবে সেখান থেকে তিনি সরে এসেছেন। তৎসম শব্দ, দেশজ- লোকজ শব্দ এবং চেনা ইংরেজি শব্দের মিশেল দিয়ে তিনি নিজস্ব কাব্যভাষা তৈরি করেন। অনিকেত শামীমের কবিতা নির্মেদ। সাম্প্রতিক বিষয় ভাবনার সঙ্গে চিরকালীনতা তিনি মিশ্রণ করেছেন। কবিতার রূপ-রস-গন্ধ একেবারেই অন্যরকম বলে অনিকেত শামীমকে স্বাগতম। হাতে উড্ডীন হবেই। অনিকেত শামীমের কবিতার মূল সুর উপলব্ধি করার জন্য দুএকটি উদাহরণ দেয়া যাক। ১. ঘুম নেই ঘুম নেই আহাজারি বুকের রেডিয়ামে। রাতভর জেগে থাকে সন্ধানী চোখ অসংখ্য (সন্ধানী চোখ)
২. তুমুল ভাঙনের শব্দে নিদ্রাসমগ্র থেকে পুনর্বার জেগে উঠে আমরা আমাদের অস্তিত্বে খেলা করে বোবা সময় আর বোবা সময়ের সুতো বেয়ে মনে পড়ে নীল উপখ্যান... (সোমপুর বিহারের বালিকা)
৩. একটি একটি করে ইটের গাঁথুনি দিয়ে যেভাবে গড়ে ওঠে প্রাসাদ একজন কবি যেভাবে শব্দের নিপুণ মুদ্রায় তৈরি করেন কবিতা যুবক... তপ্ত রৌদ্রকে উপেক্ষা করে পেরোতেই হবে অবিশ্রান্ত পথ। (একজন যুবক... রোদেলা দুপুর ও অবিশ্রান্ত পথ)
উদাহরণ তো আরও দিতে ইচ্ছা হয়। বরং পুরো বইটাই পড়ে ফেলা সহজ। অনিকেত শামীম খুব আশাবাদী কবি। তিনি শান্তিবাচী। তিনি আলোর প্রত্যাশা। তিনি জীবনের গল্প সুন্দরভাবে গদ্যছন্দে তুলে ধরেন। অনিকেত শামীমের অনেক সফল কর্মময় জীবন। ‘লোক’ সম্পাদক হিসেবে তিনি দেশবরেণ্য। সাহিত্য সম্পাদক ও লিটলম্যাগ আন্দোলনকারী হিসেবে তিনি এক ও অদ্বিতীয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক। সাহিত্য উন্মাদ ব্যক্তি তিনি। বহুমুখী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কোনো এক আড্ডায় কথাচ্ছলে বলেছিলেনÑ শিল্পের ভালো মন্দ বিচারের চাইতে মৌলিকত্ব বিচার করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যে কবিতার উত্তর ও পূর্ব পুরুষ নেই সেই কবিতা কতোটা ভালো হয়েছে তার চেয়ে সেই কবিতার মৌলিকত্ব বিচার করা বেশি জরুরি। অনিকেত শামীমের প্রতিনিধিত্বশীল কবিতাগুলো পড়তে পড়তে বারবার ভেবেছি, শামীমের নিজস্ব বাকভঙ্গি আছে। তার কাব্য প্রতিমা ভিন্ন সুরে ছন্দে উপস্থাপিত। গভীর, অন্তর্ভেদী গদ্যভঙ্গিতে তিনি কবিতাকে জীবন্ত করেন। শামীমের কবিতা এই নিজস্বতাই তাকে সহজে চিহ্নিত করে। তিনি বিপরীত স্রোতে পাল উড়িয়ে শীতঘুম শেষে সোমপুর বিহারের বালিকার অচল মুদ্রা রেখে আসেন। শক্তিমান এই কবির জন্য প্রার্থনা করি। তিনি মহৎ ও রঙ কবি কি না জানি না কিন্তু তার কবিতা... অভিসারী। গুচ্ছ গুচ্ছ নবকিশোরের মতোই তার কবিতা নতুন পৃথিবী নির্মাণ করে। এখানেই তার সফলতা। অথবা নিকেতনহীন অনিকেত শামীম সফলতার তথাকথিত তুলামূল্য বিচারকে উপেক্ষা করেন।